অবশেষে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আইন করতে যাচ্ছে সরকার। বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবসের এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কথা জানিয়েছেন। একই অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, আগামী বছরের মার্চ মাস নাগাদ দুটি সড়ককে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হবে। এসব শুনে একটি কথাই মনে হচ্ছে: এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে।
যে কাজটি আরও অন্তত ১০ বছর আগে শুরু করা উচিত ছিল, সেটি আমরা এখন শুরু করতে যাচ্ছি। তবু ভালো, শেষমেশ আমাদের বোধোদয় হচ্ছে। যদি আমরা এটা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে খুবই ভালো। এত কিছু বলার কারণ হচ্ছে, একটি নগরের যোগাযোগব্যবস্থা যেখানে গণপরিবহনকেন্দ্রিক হওয়া উচিত, সেখানে আমাদের ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা একরকম ব্যক্তিগত পরিবহনকেন্দ্রিক। হ্যাঁ, এটা ঠিক আমাদের মধ্যবিত্তের আর্থিক সংগতি হয়েছে, তাঁরা এখন ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারছেন। কিন্তু সেটা এ রকম লাগামহীন হয়ে গেলে কী হয়, তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল এতটা বেড়ে গেছে যে ঢাকা নগরের রাস্তার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে রাখছে ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ তাতে জায়গা হচ্ছে খুব কম মানুষের, বড়জোর ১০ শতাংশের। আর বাকি ৯০ জন মানুষের জন্য থাকছে মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। এই জ্যামের কারণে পরিবহন ব্যবসায়ীরা রাস্তায় বাস নামিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে পারছেন না। তাঁরা রাস্তা থেকে গাড়ি তুলে নিচ্ছেন। গত কয়েক বছরে ঢাকায় অনেক রুটের বাসসেবা বন্ধ গেছে। এতে একদিকে সৃষ্টি হচ্ছে গণপরিবহনের সংকট, অন্যদিকে সেই সংকট কাটাতে যাঁদের সংগতি আছে, তাঁরা গাড়ি কিনছেন। ফলাফল হচ্ছে, সড়কে যানজট আরও বাড়ছে। এ প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত গাড়ি গ্যাসে চলার সুযোগ দেওয়ার কারণেও গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
দুনিয়ার অনেক দেশেই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এমনকি রাস্তায় গাড়ি নামালে করও দিতে হয়। এটা গণপরিবহনে উৎসাহিত করার একটা কৌশল। কিন্তু অত্যধিক যানজটের কারণে যে রাস্তা ১৫ থেকে ২০ মিনিটে পাড়ি দেওয়া যায়, ঢাকায় সে রাস্তা পাড়ি দিতে লাগছে ন্যূনতম এক ঘণ্টা। তবে যাঁরা ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন, তাঁদের কিন্তু সময় তেমন একটা কম লাগে না, তাঁরা শুধু গাড়িতে আরামে থাকেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে। এতে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। থমকে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধির চাকা, বাড়ছে ব্যবসার খরচ। এ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বহুবার আপত্তি জানিয়েছেন, কিন্তু কেউ এত দিন তাতে কর্ণপাত করেনি।
তবে সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে গণপরিবহন-ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। অন্য কথায়, এতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। সব রুটেই ভালো বাস দিতে হবে। মেট্রোরেল হচ্ছে, তার সঙ্গে চক্ররেল-সেবা চালু করা যেতে পারে। এসব করা গেলে অনেকে হয়তো স্বেচ্ছায় ব্যক্তিগত গাড়ি ছেড়ে গণপরিবহনে চলাচল করবেন। কারণ, অল্প খরচে ঝামেলাহীনভাবে যাতায়াত করা গেলে ব্যক্তিগত গাড়ির তো প্রয়োজন হবে না। আবার গণপরিবহনের জন্য র্যাপিড ট্রানজিটের ব্যবস্থা করা যায়। এটা করা গেলে আরও ভালো। এতে গণপরিবহন আলাদা লেনে বিরামহীনভাবে চলতে পারবে। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে যাতায়াত করার কথা ভাববে।
ঢাকার সড়কের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে গণপরিবহন-ব্যবস্থা উন্নত করা গেলে মানুষ এই গাড়ি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা মানতে হয়তো আপত্তি করবে না। তবে এটা যথাযথভাবে করতে হবে। আইন সবার বেলাতেই প্রযোজ্য।
No comments :
Post a Comment